ঝাড়গ্রাম নিউজ ফ্ল্যাশ ডেক্স:- শরীর শীতল রেখে এনার্জি ধরে রাখতে পারাই হল গ্রীষ্মে ভালো থাকার চাবিকাঠি। এই গরমে মাথা ও শরীর ঠান্ডা রাখবে এমন পানীয় ও খাদ্যের খোঁজ দিলেন রাজীব গান্ধী মেমোরিয়াল আয়ুর্বেদিক কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর ডাঃ লশ্রী মজুমদার। এই সময়কালকে আয়ুর্বেদ মতে আদানকাল বলা হয়। এসময় সূর্যদেব মার্গস্বভাববশতঃ অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, উষ্ণ ও রুক্ষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও উষ্ণ ও রুক্ষ হয়ে সংসারের জলীয় তত্ত্বকে শুকিয়ে সৌম্যগুণের নাশ করে। এর ফলে শরীরস্থিত জলীয়াংশ কফ ধাতুর ক্ষয় শুরু হয়, শরীরে দুর্বলতা, ছটফটানি, গ্লানি, অনুৎসাহ, ক্লান্তি, তৃষ্ণা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এই সময়ে মানুষের হজমক্ষমতা কমে যায় এবং শরীরে জলের পরিমাণও কমে যায়। তাই এই দুই বিষয়ের উপর লক্ষ্য রেখে মানুষের খাদ্যতালিকা এবং জীবনযাত্রার উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কী করবেন, কী করবেন না?
এই সময়ে আমাদের শরীরে বেশি পরিমাণে তরল পদার্থের চাহিদা বাড়ে। বার বার শীতল জল ও পানীয় পদার্থ ও অল্প পরিমাণে হালকা সহজপাচ্য খাদ্যদ্রব্য নেওয়া উচিত।
আমিষজাতীয় পদার্থ বিশেষ করে মাছ, মাংস, ডিম এবং বাজারের ফাস্টফুড বেশি পরিমাণে না খাওয়াই উচিত।
জল বা জলীয় দ্রব্য যেমন—ঠান্ডা জল (অবশ্যই ফ্রিজের নয়) (মাটির কলসিতে রাখা জল), ডাবের জল, টাটকা ফলের রস পুদিনার শরবত, আমের সরবত, ঘোল মিছরির শরবত, ধনে ও মৌরী ভেজানো শীতল জল ইত্যাদি বেশি পরিমাণে পান করতে হবে।
ঠিক তার বিপরীতে অতিরিক্ত চা, কফি, কার্বোনেটেড ড্রিঙ্কস-এর পরিমাণ কমাতে হবে। মনে রাখবেন, এইরকম পানীয় শরীরকে জলশূন্য করতে সাহায্য করে। (কার্বনেটেড ড্রিংকস-এর অ্যাসিড ও কফিতে ক্যাফেইন থাকার জন্য)।
এইসব দিনে মদ্যপান করা নিষেধ। যদি অভ্যেস থাকে তাহলে অল্প পরিমাণে পান করা উচিত। অথবা প্রচুর পরিমাণে জলের সহিত পান করা উচিত।
এই সময়ে সাবধানতা অবলম্বন না করলে সানস্ট্রোক, ক্লান্তি, ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালেন্স, তৃষ্ণা রোগ দেখা যেতে পারে।
ফলের মধ্যে তাজা ফল তরমুজ, খরমুজ, নারকেল, মুসাম্বি, আম, আপেল, বেদানা, ফলসা, আখ ইত্যাদি খুবই উপকারী।
অধিক পরিমাণে মধুর জাতীয় আহার, লঘু ও স্নিগ্ধ আহার, শীতল পানীয়, প্রাণায়াম, মর্নিং ওয়াক, মুখে ও দেহে চন্দনের প্রলেপ দিলে লাভ হয়। চন্দনের গন্ধযুক্ত সুগন্ধি, শীতল জলে স্নান, যতটা সম্ভব শীতল গৃহে থাকা শরীরের পক্ষে ভালো।
বেশি পরিমাণে লবণ, কটু (ঝাল), অম্ল (টক), উষ্ণ সেবন উড়িয়ে চলবেন।
অধিক ব্যায়াম করবেন না।
বাসি, ফ্রিজের জিনিস, কড়া রসালো পদার্থ নৈব নৈব চ। রেড মিট খাবেন না।
কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম, কৌটা বন্দি ফল একেবারেই খাবেন না।
সূর্যের প্রখর তাপে বাইরে বেরনো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। খুব প্রয়োজনে যেতে হলে ছাতা ব্যবহার করুন।গ্রীষ্মে সুস্থ থাকার পানীয়এই গ্রীষ্ম ঋতুতে বায়ুর শমনার্থে ও শরীরের জলীয় অংশের সমতা বজায় রাখতে মধুর, তরল সুপাচ্য, হালকা, টাটকা, সিগ্ধ রসযুক্ত, শীতলগুণযুক্ত পুষ্টিকর পদার্থ সেবন করা উচিত। নীচে কয়েকটি প্রাকৃতিক ও আয়ুবের্দিক পানীয় দেওয়া হল, যা এই ঋতুতে অতি উত্তম।১.ডাবের জল ও ফলের রস: ফলের রস অবশ্যই টাটকা হতে হবে। যেমন আখের রস, মুসাম্বির রস, আঙুরের রস, বেদানার রস ইত্যাদি। আখের রস বীর্যবর্ধক, শীতল, রক্ত পিত্তনাশক, মধুর গুরু পুষ্টিকারক। যন্ত্রের দ্বারা পেষিত রস পান না করাই ভালো।২. পানক: পানক হল গুড় বা চিনি দিয়ে তৈরি পানীয়।
গুড় থেকে তৈরি পানক: এক লিটার শীতল জলে ৩০ গ্রাম গুড় (আখের গুড়) ভালো মিশিয়ে এবং তাতে শুকনো আদা চূর্ণ, এলাচ চূর্ণ, দারুচিনি চূর্ণ ১ চিমটি করে দিয়ে নাড়িয়ে নিয়ে ছেঁকে নিতে হবে।
আম পানক: কাঁচা আমকে ভালো করে সিদ্ধ করে বা পুড়িয়ে হাত দিয়ে ভালো করে রস বার করে, তার মধ্যে চিনি ও শীতল জল মাত্রানুসারে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে এবং পরে কর্পূর ও মরিচচূর্ণ যৎসামান্য দিয়ে ছেঁকে নিতে হবে।
ধনিরা পানক: ধনে চূর্ণ করে বস্ত্রে ছেঁকে নিতে হবে এবং তারপর মাত্রানুসারে চিনি ও কর্পূর মিশিয়ে নিতে হবে। এই পানক মিছরি, কিসমিস, ফলসা দিয়েও তৈরি করা যেতে পারে। তাছাড়া তেঁতুল, লেবুর পানক করা হয়। এই পানক কষ্ট দূর করে, মুর্চ্ছা, দাহ, তৃষ্ণা হর, রুচিবর্ধক, বলকারক, বাতনাশক এবং শীঘ্রই ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করে। পানক অবশ্যই মাটির পাত্রে রাখবেন।
মন্থ: মন্থ তৈরির জন্য উত্তম হল মাটির পাত্র। একটি মাটির পাত্রে শীতল জল রেখে, তাতে পেষাই করা বা চূর্ণ করা দ্রব্য (৪:১) (দ্রব্য ১ভাগ, জল ৪ভাগ) রাখতে হবে। সম্যক ভেজার পর ভালোভাবে মিশিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এই মন্থ খেজুর, দাড়িম, কিসমিস, ফলসা, আমলকীর করা যেতে পারে। চিনি, আখের রস, কিসমিস দিয়ে তৈরি মন্থ হল পিত্তনাশক। পঞ্চসার বা মধু, খেজুর, কিসমিস, ফলসা ও মিছরির জলের মন্থ পিপাসানাশক তৃপ্তিকর ও বলকারক।
ছাতু: ছাতু বিভিন্ন পদার্থ যেমন যব, ছোলা, মুসুর ডাল, শালি ধান্য দিয়ে করা যেতে পারে।১. যবের ছাতু বা যব ও ছোলার মিশ্রিত ছাতু: ঘৃত সংযুক্ত বা মিছরি গুড়যুক্ত। যেটি হবে একদম পাতলাও না, গাঢ়ও না। যবের ছাতু ইনস্ট্যান্ট শক্তি উৎপন্ন করে। তৃষ্ণা নাশ করে। বলদায়ক, বীর্যবর্ধক, তৃপ্তিকারক, মধুর, শ্রম, খিদে, নেত্ররোগ দাহ হর। গরমের পক্ষে অতি উত্তম পানীয়।২. চালের ছাতু: অগ্নিকারক, লঘু, শীতল, মধুর, শুক্রজনক, তৃষ্ণানাশক।
রাগষাড়ব: মুগ ডাল জলে সিদ্ধ করে তার জ্যুস বানিয়ে নিতে হবে। এর সঙ্গে দাড়িম রস ও বড় কিসমিস মিশিয়ে তৈরি করে নিতে হবে রাগষাড়ব। অত্যন্ত রুচিকর, লঘুপাকী।
রাগ: রাগ হল বিভিন্ন পদার্থের মিশ্রণ বা সিরাপ। সময়মতো প্রয়োজনমতো পরে তৈরি করেও পরিবেশন করা যেতে পারে। যেমন—আঙুর, চন্দন, উষির, কমল, গোলাপ, যষ্টিমধু এই দ্রব্যগুলি ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে চূর্ণ করতে হবে। পরিমাণ ৬০ গ্রাম নিয়ে ১.২ লিটার জলে ভালো করে মন্দ আঁচে ফুটিয়ে যখন ৩০০ এমএল হবে তখন ১৫০ গ্রাম মতো চিনি দিতে হবে। এবং ফুটিয়ে যখন সিরাপের ঘনত্ব হবে তখন ছেঁকে নিতে হবে। একেই রাগ বলে। যখন পরিবেশন করা হবে এর ২০ এমএল নিয়ে সঙ্গে শীতল জল ও চিনি মিশিয়ে পানীয় প্রস্তুত করে নিতে হবে। এটি শরীরকে ঠান্ডা করে, তৃষ্ণা মেটায়, দাহ নিবারক, পিত্ত হর—সর্বোপরি মনকে শান্ত করে।
রসালা: এটি তৈরি করা অত্যন্ত সহজ। পাশাপাশি খুবই পুষ্টিকারক। বাত পিত্তকে শমন করে, অগ্নিকে প্রদীপ্ত করে।প্রস্তুতি: দই এক কাপ, চিনি ও জল কাপ, শুকনো আদা চূর্ণ ২ চিমটি। জিরা ১ চিমটি, ধনে ১ চিমটি, সৈন্ধব লবণ স্বাদ অনুযায়ী। বা দই ১ কাপ, জল কাপ, মধু ২ চামচ, এলাচ ২টা, গোলাপ জল ১ চামচ, চিনি কাপ মতো। এগুলি একসঙ্গে মিশিয়ে রসালা তৈরি।
খাণ্ডব: অম্ল, মধুর, লবণ রসের ঘোল।প্রস্তুতি: শীতল জলে, মিছরি, চিনি, গুড় ও অল্প লেবুর রস ও লবণ মিশিয়ে যে সরবত তৈরি হয়, তাকেই খাণ্ডব বলে। প্রচণ্ড গরমে জিরে ও মৌরি ভেজানো জলে মিছরি মিশিয়ে নিলে অতি উত্তম পানীয় যা সহজেই হাতের নাগালের মধ্যে। শীতল জলে শুধুমাত্র যদি গুড় মিশিয়ে নেওয়া যায়। তাও গরমে অতি উত্তম। শুধুমাত্র শীতল জল (মাটির পাত্রে রাখা জল হলে ভালো) ও খুব ভালো। এটি মূর্ছা, পিত্তসম্বন্ধীয় রোগ, গরম, রক্ত বিকার, শ্রম ইত্যাদিতে বিশেষ উপকারী। শ্রীখণ্ড: মোষের দুধে তৈরি দই তিনভাগ, চিনি দই-এর অর্ধেক ও দুধ দই-এর দ্বিগুণ ভালো করে মিশিয়ে, তাতে ছোট এলাচ বীজ, লবঙ্গ, কর্পূর, মরিচ ইত্যাদি চূর্ণ প্রয়োজন মতো মেশালে তৈরি হয় শ্রীখণ্ড। এটি বলকারক, বাত ও পিত্ত নাশক, অগ্নিদীপক স্নিগ্ধ, মধুর, শীতল, তৃষ্ণা, দাহ হর।
শরবত: শীতল জলে চিনি মিশিয়ে সামান্য এলাচ, লবঙ্গ, কর্পূর ও মরিচ চূর্ণ দিয়ে ছেঁকে নিয়ে সরবত তৈরি করা হয়। এটি শুক্রজনন, শীতল, বলকারক, মুর্ছা, তৃষ্ণা, দাহ শান্ত করে।