Breaking
24 Dec 2024, Tue

সোনা জয়ী তীরন্দাজ আজ অভাবের তাড়নায় টোটো চালক

নিউজ ফ্ল্যাশ ডেক্স:- গতকালই সংবাদের শিরোনামে উঠে এসেছে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাভপুরের তীরন্দাজ স্বকীর্তি, কারন সে এ মাসেই দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চলেছে। স্বকীর্তি, যেমন দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে জেলার নাম উজ্জ্বল করেছে, তাকে নিয়ে যখন আমরা গর্বিত, ঠিক তখনই কয়েক কিলোমিটার দূরেই অবহেলায়, অনাদরে পড়ে রয়েছে আর এক সোনাজয়ী তীরন্দাজ লোকনাথ হাজরা। অর্থাভাবে, পরিকাঠামোর অভাবে সে এখন তীরন্দাজ না, একজন টোটো চালক। তীরন্দাজিতে সোনা পেয়েও তাকে বর্তমানে পেটের ভাত জোগানোর জন্য টোটোকে অবলম্বন করতে হয়েছে। সে আর কেউ না, বীরভূমের নানুরের উচকরণ গ্রামের লোকনাথ হাজরা।

বীরভূমের নানুরের উচকরণ গ্রামে ১৯৯৬ সালে জন্মগ্রহণ করার পর মাধ্যমিক পঠন-পাঠন হয় উচ্চারণ হাইস্কুলেই। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সেরে ফেলে নানুরের সি.এম. হাইস্কুল থেকে। স্কুলে শিক্ষকেরা তার খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখে বোলপুর স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়াতে তীরন্দাজি শেখার পরামর্শ দেন। পড়াশোনায় তেমন প্রতিভাশালী না হলেও খেলাধুলায় যে তার যথেষ্ট প্রতিভা রয়েছে তা পরবর্তীকালে একের পর এক প্রতিযোগিতায় প্রকাশ পেতে থাকে। প্রশিক্ষণ নেওয়া কালিনীই কলকাতা, আসাম, হরিয়ানার মত বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক পদক আসতে থাকে তার ঝুলিতে। সাধারণ একজন চাষির ঘরের ছেলে লোকনাথ নিজের ঝুলিতে সোনা, রূপো, ব্রোঞ্জ মিলে কমপক্ষে নটি পদক ও প্রশংসাপত্র হাসিল করে নেয় সেই সকল প্রতিযোগিতা থেকে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর সে পাঞ্জাবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ পায়। সেই সুযোগ অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কিছুদিন সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরই হঠাৎ করে বাড়িতে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাবা একজন সাধারণ চাষী, তার দেখভাল এবং বাড়ির অন্যান্য কাজকর্ম দেখার জন্য তাকে সুদূর পাঞ্জাব থেকে ফিরে আসতে হয় নিজের উচকরণ গ্রামে। ব্যাস, তারপরই তার জীবনের সমস্ত স্বর্ণযুগ ধুলোয় মিশে যায়। আর নতুন করে কোথাও প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ মিলেনি অথবা অর্থাভাবে সেই সুযোগ নিজে তৈরিও করতে পারেনি।

পাঞ্জাবের প্রশিক্ষণ শিবির থেকে তার ফিরে আসা ২০১৬ সাল, তারপর বছর খানেক বাড়িতেই বসে থাকার পর অবশেষে টালমাটাল সংসারের হাল সামলাতে তাকে ধরতে হয় টোটোর স্টিয়ারিং। ২০১৮ সাল থেকে সে এখন নানুরে উচকরণ গ্রামের পরিচিত এক মুখ টোটো চালক হিসাবে। একসময়ের স্বর্ণপদক জয়ী সেই ছেলের আসল প্রতিভা, আসল পরিচয় লোকে প্রায় ভুলতেই বসেছে। তবে এসবের পরেও সে তার জীবিকা নিয়ে এতোটুকু ক্ষুব্ধ নেই, তাহলেও সামান্যতম ক্ষোভ ধরা পরে তার চোখে মুখে।

লোকনাথ হাজরার সাথে কথা বলে জানা যায়, এ যাবত সে কোন রকম সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য পায়নি যাতে করে সে তার প্রতিভাকে আরো একটু আগেই নিয়ে যেতে সচেষ্ট হতো। সেই ক্ষোভের পরিস্ফুটন রয়েছে তার কথায়। “স্কলারশিপ অথবা অন্য কোনো সাহায্যের জন্য কি করতে হয় সেটা সেসময় আমার ওই সময় জানা ছিল না। বাবা মাও জানতো না। গুরুজনদের কাছে সাহায্য চাইলে সদিচ্ছার অভাব ছিল তাদের মধ্যে। গ্রামের বা এলাকার কোন দলীয় নেতা নেত্রীও তার পাশে সে সময় দাঁড়াননি কোন রকম সহযোগিতার জন্য।”

পৃথিবীতে অর্থই যে আসল পরিচয় সে কথা আবার প্রমাণিত। হয়তো সেদিন যদি এই লোকনাথের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতো তাহলে হয়তো সেই আজকে হয়ে উঠতো বীরভূমের ওই ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন খ্যাতনামা তীরন্দাজ।

Developed by