কংসাবতীর তীরে মন্দিরময় লালগড়

স্বপ্নীল মজুমদার : কংসাবতী নদীর তীরে ‘মন্দিরময় লালগড়ের’ কথা অনেকেরই হয়তো অজানা। ঝাড়গ্রাম জেলার বিনপুর-১ ব্লকের লালগড় ও রামগড় অঞ্চলের প্রাচীন মন্দির ও রাজপ্রাসাদগুলি সংস্কারের অভাবে ধ্বংসের পথে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, অনুপম স্থাপত্য-কীর্তি গুলির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। মন্দির গুলির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, এলাকার অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য। প্রাচীন দ্রষ্টব্যগুলিকে কেন্দ্র করে লালগড়ে পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা যেত। কিন্তু সেটাও হয়নি।লালগড়ে পর্যটকদের থাকার কোনও জায়গাই নেই।

লালগড় ব্লক সদরে রয়েছে ‘সাহসরায়’ রাজাদের প্রাসাদ। দোতলা রাজপ্রাসাদটির ভগ্নদশা। রাজ পরিবারের কয়েক শরিক ভাগাভাগি করে বাস করেন। প্রাসাদের জরাজীর্ণ অবস্থার জন্য নিজের অংশে থাকার ঝুঁকি নেননি রাজ পরিবারের সদস্য দর্পনারায়ণ সাহসরায়।শেষ রাজা বিজয়নারায়ণ সাহসরায়ের পৌত্র দর্পনারায়ণবাবু কিছুটা অন্য বাড়িতে থাকেন।

রাজ পরিবারের প্রাচীন মন্দিরগুলির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন রাজপরিবারের শরিকরা। এর মধ্যে আনুমানিক সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো ‘রাধামোহন জিউ’য়ের মন্দিরটি বিষ্ণুপুরি জোড়বাংলা শৈলীর। প্রাচীন স্থাপত্যের বিস্ময়কর সৃষ্টি লালগড়ের এই মন্দিরের গর্ভগৃহটি প্রাকৃতিক ভাবেই বাতানুকূল। কানাইলাল ও শ্রীমতী এবং কুলদেবী সর্বমঙ্গলা-সহ বিবিধ দেবদেবীর নিত্যপুজো হয়। ওই মন্দির প্রাঙ্গণেই সর্বমঙ্গলার আদি দোতলা দালান মন্দিরটিরও বেহাল অবস্থা। পরিত্যক্ত ওই মন্দিরগাত্রে পোড়া মাটির অনুপম করুকাজ দেখে বিস্মিত হতে হয়। ভগ্নদশার জন্য বেশ কয়েক বছর আগে সর্বমঙ্গলার বিগ্রহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় রাধামোহন জিউ মন্দিরের গর্ভগৃহে।

লালগড়ে রাধামোহন জিউয়ের রথযাত্রা আজও নজর কাড়ে। রাজ পরিবারের দেওয়ালি দুর্গামন্দিরটিও তিনশো বছরের পুরনো। মন্দিরের গর্ভগৃহের দেওয়ালে চুন ও সুরকির দুর্গামূর্তিটি খোদাই করা বলেই সম্ভবত দেওয়ালি দুর্গামন্দির নাম। আনুমানিক ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে লালগড়ের অন্যতম রাজা স্বরূপনারায়ণ সাহসরায় রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে দেওয়ালি দুর্গা মন্দির নির্মাণ করেন।
লালগড় থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে রামগড়ে এক সময় ‘সিংহ সাহসরায়’ রাজাদের রাজত্ব ছিল। রামগড় রাজাদের প্রাসাদটি পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছে। রামগড়ে সাহসরায় রাজাদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরগুলির মধ্যে কালাচাঁদ জিউয়ের মন্দিরটি উল্লেখযোগ্য। আঠারো চূড়া বিশিষ্ট টেরাকোটার মন্দিরটির দেওয়াল জুড়ে রয়েছে নানা চিত্রশিল্প। সেখানে ইউরোপীয় প্রভাবও রয়েছে।

১২৬৩ বঙ্গাব্দের ২১ বৈশাখ রামগড়ের তখন রাজা বাহাদুর সিংহ সাহসরায়ের উদ্যোগে স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন এই মন্দিরটি তৈরি হয়। বর্তমানে বিগ্রহ শূন্য মন্দিরটির জরাজীর্ণ অবস্থা। রামগড় রাজবাড়ির ভিতরে রয়েছে রাসমন্দির। এ ছাড়া রামগড়ের বুড়ো শিবের মন্দির, শীতলা মন্দির ও ১২৭০ বঙ্গাব্দে রাধাকৃষ্ণ দাসরায় প্রতিষ্ঠিত রাধেশ্যাম মন্দিরটিও বিশেষ দ্রষ্টব্য। রামগড়ের মন্দিরগুলিতেও রয়েছে টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকাজ। রামগড়ের অদূরে মৌজিথানে শূরবাঁধের কাছে রয়েছে বনদেবী মা মৌজি’র মন্দির। ইতিহাসবিদদের মতে, ‘‘জোড় বাংলা মন্দিরটি বিষ্ণুপুরের মল্লভূমের মন্দিরের আদলে তৈরি। একটি দোতলা দালান মন্দির এই এলাকায় রয়েছে, যা বাংলায় বিশেষ দেখা যায় না। এ ছাড়া লালগড়ের অন্য মন্দিরগুলির ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ইউরোপীয় প্রভাবও দেখা যাচ্ছে। সে কারণে এগুলি আরও গুরুত্বপূর্ণ।’’ ইউরোপীয় প্রভাব বিশেষ করে দেখা যায় কালাচাঁদ মন্দিরের টেরাকোটার কাজে বন্দুকধারী টুপি পরা সেপাইয়ের মূর্তিতেও।

লালগড়ের নেতাই গ্রামের কিছুটা দূরে ডাইনটিকরি গ্রামে রয়েছে মাকড়া পাথরের তৈরি প্রাচীন একটি বৌদ্ধ উপাসনালয়। স্থানীয় ইতিহাসবিদদের ধারণা, উপাসনালয়টি সাত-আটশো বছরের পুরনো। কংসাবতীর তীরঘেঁষা পুব মুখো উপাসনালয়টির পঞ্চরথ পীঢ়া দেউল শৈলীর। মন্দিরে উপরের ছাদ ৯টি ধাপে বিভক্ত এবং ভিতরের ছাদ লহরা পদ্ধতিতে তৈরি। মন্দিরের একটিই প্রবেশদ্বার। এখন অবশ্য কোনও দরজা নেই। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আগে লোহার দরজা ছিল। মন্দির সংলগ্ন একটি পাথরে বাঁধানো শতাব্দী প্রাচীন পাতকুয়োর ভগ্নাবশেষ রয়েছে। জনশ্রুতি, মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে নদীর তীর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে। স্থানীয় গবেষকদের একাংশের দাবি, কয়েকশো বছর আগে বৌদ্ধভিক্ষুরা এখানে আহুতি দিতেন। মন্দির সংলগ্ন একটি ফাঁকা জায়গায় প্রচুর ভাঙাচোরা প্রাচীন মৃত্‌পাত্র পাওয়া গিয়েছিল। আহুতির জন্য মৃত্‌পাত্রগুলি ব্যবহৃত হত বলে গবেষকদের দাবি। প্রচলিত জনশ্রুতি, অনেককাল আগে এই মন্দিরে রংকিনি নামে এক রাক্ষসী থাকত। সেই কারণে এই মন্দিরটি রংকিনি মন্দির নামেও পরিচিত। এখন অবশ্য মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নেই। আগে কী ধরনের বিগ্রহ ছিল, তা নিয়েও কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই। যে কোনও সময় মন্দিরটি নদী ভাঙনে তলিয়ে যেতে পারে বলে স্থানীয় মানুষের আশঙ্কা।
জঙ্গলমহলের বহুচর্চিত লালগড় এলাকার পুরনো স্থাপত্য-কীর্তির ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে প্রাচীন মন্দিরগুলির সংস্কার ও উপযুক্ত সংরক্ষণ হওয়া জরুরি বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

Recent Posts

স্নান করতে নেমে বিপত্তি, ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেলেও তলিয়ে যাওয়া যুবকের মিলল না কোন সন্ধান!

অরূপ কুমার মাজী, জেএনএফ, সরডিহা : বন্ধুদের সাথে স্নান করতে নেমে কংসাবতী নদীর জলে তলিয়ে গেল এক যুবক। ঘটনাটি ঘটেছে…

1 month ago

শরীর সায় দিলে ‘দিদি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ! অনুগামীদের ভিড়, বাড়ির কার্যালয়ে বসে কেঁদে ফেললেন অনুব্রত

দুই বছরেরও বেশি সময় পরে বীরভূমে ফিরলেন অনুব্রত মণ্ডল। প্রথমে আসানসোল সংশোধনাগারে এবং তার পর প্রায় দেড় বছর দিল্লিতে তিহাড়…

1 month ago

‘সঞ্জয় লীলার কোনও নীতি আদর্শ নেই!’ পরিচালকের বিরুদ্ধে কেন ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন করিনা?

করিনার সৌন্দর্যে প্রথম থেকেই মুগ্ধ ছিলেন পরিচালক। ‘হম দিল দে চুকে সনম’ ছবির জন্য তাঁর প্রথম পছন্দ ছিলেন করিনাই। কিন্তু…

1 month ago

মিছিল করে মিছিলের উপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ স্কুল পড়ুয়াদের! শোকজ় নোটিস পেয়ে ক্ষোভ একাধিক জেলায়

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিলে কচিকাঁচা পড়ুয়ারা পা মেলিয়েছে কেন? এই প্রশ্ন তুলে রাজ্যের বেশ কয়েকটি স্কুলকে শোকজ় নোটিস পাঠিয়েছে শিক্ষা…

2 months ago

বালি মজুত করার অভিযোগ পেয়ে শুকজোড়া এলাকায় ভূমি অধিকারীকের হানা!

জেএনএফ, চুবকা : অবৈধভাবে বালি মজুত করার অভিযোগ পেয়ে ঝাড়গ্রাম ব্লকের শুকজোড়া এলাকায় মানিকপাড়া বিট হাউসের পুলিশকে সাথে নিয়ে হানা…

3 months ago